ব্যান্ড তত্ত্বের আলোকে পরিবাহী, অপরিবাহী এবং সেমিকন্ডাক্টর

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ২য় পত্র | NCTB BOOK

তড়িৎ পরিবাহিতা ধর্মের ওপর ভিত্তি করে কঠিন পদার্থকে তিন শ্রেণিকে ভাগ করা যায়— যথা: অপরিবাহী, পরিবাহী এবং সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী । ব্যান্ড তত্ত্বের দ্বারা এদের প্রত্যেকের আচরণ ব্যাখ্যা করা যায়।

অপরিবাহী বা অন্তরক : যে সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চলতে পারে না তাদেরকে অপরিবাহী বলে। যেমন কাচ, কাঠ ইত্যাদি। অপরিবাহীর আপেক্ষিক রোধ অনেক বেশি—প্রায় 1012  Ωm ক্রমের।

চিত্র :১০.৩

অপরিবাহীতে যোজন ব্যান্ড ইলেকট্রন দ্বারা আংশিক পূর্ণ থাকে এবং পরিবহন ব্যান্ড ফাঁকা থাকে। এছাড়া যোজন ব্যান্ড এবং পরিবহন ব্যান্ডের মধ্যবর্তী শক্তি ব্যবধান অনেক বেশি, 6 eV থেকে 15 eV এর মতো (চিত্র : ১০.৩)। ফলে সাধারণ তাপমাত্রায় অপরিবাহীর দুই প্রান্তে বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করলেও এ থেকে ইলেকট্রনগুলো উচ্চতর শক্তিস্তরে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করতে পারে না । এ জন্য সাধারণ তাপমাত্রায় অপরিবাহীর ভেতর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চলে না।

চিত্র :১০.৪

 পরিবাহী : যে সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে সহজে তড়িৎ প্রবাহ চলতে পারে তাদেরকে পরিবাহী বলে। সাধারণত ধাতব পদার্থ তড়ি সুপরিবাহী হয়। তামা, রুপা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি সুপরিবাহী।

পরিবাহীর আপেক্ষিক রোধ কম হয়—–প্রায় 10-8Ωmm ক্রমের। পরিবাহীতে অনেক মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। পরিবাহীতে যোজন ব্যান্ড এবং পরিবহন ব্যান্ডের মাঝে শক্তি ব্যবধান তো থাকেই না বরং কিছু অংশে এদের উপরিলেপন ঘটে (চিত্র : ১০.৪)। এ জন্য পরিবাহীর দুই প্রান্তে সামান্য বিভব পার্থক্য ঘটলেই মুক্ত ইলেকট্রনগুলো তড়িৎ প্রবাহের সৃষ্টি করে।

সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী : অপরিবাহী ও পরিবাহীর মাঝামাঝি আপেক্ষিক রোধের কয়েকটি পদার্থ আছে সেগুলোকে বলা হয় সেমিকন্ডাক্টর। 

যেমন— জার্মেনিয়াম, সিলিকন ইত্যাদি। এদের আপেক্ষিক রোধ 10-4 Ωm ক্রমের। কিন্তু কেবল আপেক্ষিক রোধ দিয়েই সেমিকন্ডাক্টর চিহ্নিত করা হয় না। কেননা কিছু সংকরও আছে যাদের আপেক্ষিক রোধ জার্মেনিয়াম, সিলিকন প্রভৃতির সমক্রমের কিন্তু সেগুলো সেমিকন্ডাক্টর নয়। সেমিকন্ডাক্টরের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, এর আপেক্ষিকবোধ 10-4Ωm ক্রমের। এতে কোনো অপদ্রব্য মিশালে এর তড়িৎ পরিবাহিতাঙ্ক বৃদ্ধি পায়। পরমশূন্য তাপমাত্রায় (OK, শূন্য কেলভিন) এরা অপরিবাহী। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা পাল্লা পর্যন্ত এর রোধ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে হ্রাস পায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে এর তড়িৎ পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায়। দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী বিভব পার্থক্য বৃদ্ধি করলে এর তড়িৎ পরিবাহিতাঙ্ক বৃদ্ধি পায়। এদের পরিবহন ও যোজন ব্যান্ডের মধ্যে শক্তি পার্থক্য l.l eV বা এর কম (চিত্র : ১০.৫)।

চিত্র :১০.৫

   সুতরাং বলা যায় যে, 

   যে সকল পদার্থের পরিবাহিতার অপরিবাহী ও পরিবাহীর মাঝামাঝি এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে যাদের রোধ কমে অর্থাৎ পরিবাহিতার বাড়ে এবং সুবিধাজনক অপদ্রব্য যোগ করলে যাদের পরিবাহিতাঙ্ক ধর্মের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে তাদেরকে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী বলে।

 

ব্যান্ড তত্ত্বের আলোকে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী

যে পদার্থে যোজন ব্যান্ড প্রায় পূর্ণ এবং পরিবহন ব্যান্ড প্রায় খালি থাকে এবং এই দুটি ব্যান্ডের মধ্যে শক্তির পার্থক্য খুব কম (অনধিক 1.1eV) থাকে তাকে সেমিকন্ডাক্টর বলে। (চিত্র ১০.৫)।

চিত্র :১০.৬

  জার্মেনিয়াম হচ্ছে একটি বহুল ব্যবহৃত আদর্শ সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী। জার্মেনিয়ামের সর্বশেষ কক্ষপথে চারটি যোজন ইলেকট্রন আছে। কিন্তু এই যোজন ইলেকট্রনগুলো মুক্ত ইলেক্‌ট্রন নয়। কেননা অন্যান্য পরমাণুর মতো জার্মেনিয়াম পরমাণুও তার শেষ কক্ষপথটি আটটি ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ করতে চায়। এটি করতে গিয়ে ১০.৬ চিত্রের ন্যায় প্রতিটি জার্মেনিয়াম পরমাণু অন্য চারটি জার্মেনিয়াম পরমাণুর মাঝখানে নিজেকে স্থাপন করে। এতে প্রতিটি পার্শ্ববর্তী পরমাণু মধ্যবর্তী পরমাণুটির সাথে একটি যোজন ইলেকট্রন ভাগাভাগি করে নেয়। এই ভাগাভাগির ঘটনায় মধ্যবর্তী পরমাণুটি তার সর্বশেষ কক্ষপথটি আটটি ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ করে। এভাবে মধ্যবর্তী পরমাণুটি সহযোজী বন্ধন (Covalent bond) সৃষ্টি করে। সহযোজী বন্ধন সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ায় একটি পরমাণুর প্রতিটি যোজন ইলেকট্রন তার পার্শ্ববর্তী পরমাণুর যোজন ইলেকট্রনের সাথে সরাসরি বন্ধন তৈরি করে। অর্থাৎ যোজন ইলেকট্রনগুলো অন্যান্য পরমাণুর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ফলে সেমিকন্ডাক্টরে যোজন ইলেকট্রনগুলো মুক্ত থাকে না।

যে পদার্থে পরমাণু বা অণুগুলো একটি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্নে সজ্জিত থাকে তাকে কেলাস বলে। সকল সেমিকন্ডাক্টরের গঠন কেলাসিত। এ জন্য এক টুকরা জার্মেনিয়ামকে সাধারণভাবে জার্মেনিয়াম কেলাস বলা হয়ে থাকে।

চিত্র :১০.৭

 সেমিকন্ডাক্টরে যোজন শক্তি ব্যান্ড প্রায় পূর্ণ থাকে এবং পরিবহন ব্যান্ড প্রায় ফাঁকা থাকে। এ ছাড়া যোজন ব্যান্ড ও পরিবহন ব্যান্ডের মধ্যবর্তী শক্তি ব্যবধান খুব কম থাকে। ১০.৭ চিত্রের জার্মেনিয়াম ও সিলিকনের শক্তি ব্যান্ড রৈখিক চিত্র থেকে দেখা যায় যে, কক্ষ তাপমাত্রায় জার্মেনিয়ামের জন্য এটি 0.7eV এবং সিলিকনের জন্য 1.1 eV। ফলে তুলনামূলকভাবে কম শক্তি প্রয়োগেই ইলেকট্রনগুলোকে যোজন ব্যান্ড থেকে পরিবহন ব্যান্ডে স্থানাস্তর সম্ভব হয়। 

চিত্র :১০.৮
চিত্র :১০.৯

  পরমশূন্য তাপমাত্রায় (OK) সেমিকন্ডাক্টরে ইলেকট্রনগুলো পরমাণুতে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে। এই তাপমাত্রায় সহযোজী বন্ধনগুলো খুবই সবল হয় এবং সবগুলো যোজন ইলেকট্রনই সহযোজী বন্ধন তৈরিতে ব্যস্ত থাকে, ফলে কোনো মুক্ত ইলেকট্রন থাকে না এবং সেমিকন্ডাক্টর কেলাস এই অবস্থায় যোজন ব্যান্ড পূর্ণ থাকে এবং যোজন ব্যান্ড ও পরিবহন ব্যান্ডের মাঝে শক্তির ব্যবধান বিরাট হয় [চিত্র : ১০৮] । ফলে কোনো যোজন ইলেকট্রন পরিবহন ব্যান্ডে এসে মুক্ত ইলেকট্রনে পরিণত হতে পারে না। মুক্ত ইলেকট্রন না থাকার কারণে সেমিকন্ডাক্টর এই তাপমাত্রার বিশুদ্ধ অপরিবাহী বা অন্তরকের ন্যায় আচরণ করে।

যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা হয় তখন তাপ শক্তির কারণে কিছু সংখ্যক সহযোজী বন্ধন ভেঙে যায় এবং কিছু ইলেকট্রন মুক্ত হয়। ১০.৯ চিত্রে শক্তি ব্যান্ড রেখাচিত্র দেখানো হয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে কিছু সংখ্যক যোজন ইলেকট্রন পরিবহন ব্যান্ডে প্রবেশ করার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে এবং মুক্ত ইলেকট্রনে পরিণত হয় । এখন বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করা হলে মুক্ত ইলেকট্রনগুলো তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে। যখনই একটি যোজন ইলেকট্রন পরিবহন ব্যান্ডে প্রবেশ করে তখনই যোজন ব্যান্ডে একটি শূন্যস্থান বা গর্ত বা 'হোল' (hole) সৃষ্টি হয়। আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে দেখব কীভাবে এই হোল বা গর্তগুলো তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে।

Content added || updated By
Promotion